অনেক মানুষ মনে করে, এই জঙ্গলের আদিবাসী লোকগুলো কোনওরকম পরিবর্তন চায় না। এটা ভুল ধারণা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় জল – জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এরা আমাদের সাহায্য চায়। সবার আগে, অন্য যে কোনও মানুষের মত এরাও নিজেদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু চায়। ভদ্রবোধসম্পন্ন মানুষের নিজেদের এক্তিয়ারে স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। উচ্ছেদের পরে আমরা এদের নতুন যে জীবনদান করতে চাইছি, কোনওরকম পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াই এই লোকগুলোর বোঝার ক্ষমতা আছে যে সেই জীবনে মর্যাদাবোধ নেই – এমনই বিচক্ষণ এরা। যতদিন না আমরা এদের সেই অধিকারবোধ দিচ্ছি, এরা নিজেদের জীবন এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জারি রাখবে, সে যত স্বল্প পরিসরেই হোক না কেন। ... ...
সেই শুরু। তারপরে দীর্ঘ্য সময় গর্গ ভ্রমণ করেছেন মথুরা রাজ্যের প্রতিটি অংশ। যাদবদের রাজনীতি কেন্দ্রীভূত ছিল গণসভার অস্তিত্বের মধ্যে। সেই অস্তিত্বকে যখন কংস উপড়ে ফেলে দিল, রাজা উগ্রসেনকে বন্দী করলো, বন্দী করলো নিজ ভগিনী দেবকী এবং বান্ধব বসুদেবকে তখন মথুরা নগরে কোনো বিরোধী কেন্দ্র রইলো না। কংস ভেবেছিল বসুদেব তাকে সমর্থন করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় সে ক্ষিপ্ত হয়। এই সূত্রটা ধরলেন গর্গ। বসুদেবের মিত্রতা ছিল গোপেদের সঙ্গেও। সে বৈষ্ণবদের ‘বাসুদেব’ হতে চলেছে তখন এবং গোপেরা মূলত বৈষ্ণব। তাছাড়া সে স্বভাব বশতই মিষ্টভাষী। শ্বশুর উগ্রসেন রাজা থাকাকালীন গোপেদের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রতিনিধিত্ব সেই করতো মথুরাপুরে। প্রথমে গর্গ গোপেদের মধ্যে নিজের অবস্থান শক্ত করলেন। কণাদের পরমাণুবাদ ছাড়লেন। নিজেকে রূপান্তরিত করলেন বৈষ্ণবে। একমাত্র ধর্মই সমাজকে চালনাকারী রাজশক্তির সমকক্ষ হতে পারে। আর সেই ধর্ম বেদ, ন্যায়, সাংখ্য এ সব দিয়ে চললে হবে না। ধর্মের জনপ্রিয়তা ও শক্তির মূল ভিত্তি যে মানুষ তার কাছে সহজ হতে হবে ধর্মকে। বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে আছে সে বীজ। তাই পরিবর্তিত গর্গ বৈষ্ণব হলেন। তারপরে মথুরাপুরে খুঁজে বের করলেন কংস বিরোধী গণসভ্যদের। দ্বিতীয় কাজে তাঁর সাহায্য করেছেন কদম। যেহেতু কংসের নজর বেশী থাকবে গর্গের উপরে, তাই তিনি রাজধানীতে আসতেন না। আসতো কদম। অক্রুর, পৌল সাত্যকীরা ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছেন একমাত্র উপায় অভ্যুত্থান। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান হওয়া অসম্ভব। কংস নিজের হাতে রেখেছে সৈন্যবাহিনীকে। তাদের প্রতিপালনে সে যথেষ্ট মনোযোগীও। সাধারণ মানুষ সেই বাহিনীর সঙ্গে সমরবিদ্যায় পেরে উঠবে না। তাহলে? রাস্তা ছিল একটাই। কংসের দম্ভকে কাজে লাগানো। ঠিক সেই কাজটাই হয়েছে। ... ...
লোকটা অদ্ভুত। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, বিশাল একজোড়া পালোয়ানী গোঁফ, মাথার চুলে একগাদা তেলে জবজব, হাতে বালা। হাতে বালা অনেকেই পরে শিখদের নকল করে, বিশেষতঃ একটু দাদাগিরি করার যাদের শখ। কিন্তু এর বালাগুলো, হ্যাঁ একটা নয়, প্রায় পাঁচ ছ’ টা, স্টীলের নয়, পেতলের। সবকটা এক হাতে পরা। অন্যহাতে মোটা মোটা লাল সুতো জড়ান। এরকম পাঁচ ছ’খানা পেতলের বালাওয়ালা লোক আমি আগে দেখিনি। লোকটার ভাষাও একটু কেমন যেন। কোলকাতায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় যে সব জেলা থেকে মানুষ এসেছে, তাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের ঐতিহ্য চাপিয়ে বাংলা বলে কিন্তু এর বাংলাটা কেমন যেন। প্রথমে শুনলে মনে হয় বিহারী কষ্ট করে বাংলা বলছে। একটু ঠাওর করলে বোঝা যায়, না এটা বাংলাই কিন্তু যেগুলো আমরা শুনে অভ্যস্ত, তাদের কোনওটাই নয়। আমার কেমন জানি মনে হ’ল, লোকটা মালদা জেলার। লোকটা এই ভাড়া করা সুভ্-গাড়িটার ড্রাইভার। বলল, মেসো, গাছ দেখছেন? ... ...
... ...
জীবন মানে তো একটা পথ চলা। যেকোন পথে যেতে প্রথমদিন শুধু পথটাকেই দেখি, তাকে মাপি। পরের দিন চোখ তুলে দেখি আশপাশ, কতো গাছ, কতো হাট, কতো খালবিল। তার পরের দিন গাছের পাতা কেমন সবুজ, কী রঙের ফুল, কোন পাখির বাসা, বিলে পদ্ম ফুটেছে না শালুক, মানুষগুলি বাইরে থেকে কেমন? তার পর কোনোদিন পেরিয়ে যাই মানুষগুলির অন্দরমহল, হেঁসেলঘর। প্রথমদিন পথের দুপাশে যেমন সব কিছু অচেনা, অজানা, অবুঝ লেগেছিলো, সেই অস্বস্তিটা যে কোথায় চলে যায়, কে জানে। কবিতাও তো জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল চলে, তার প্রথম অবুঝপনা কখন যে অতীত হয়ে যায়, তার কোনও হিসেব থাকেনা। তখন নিশ্চিন্তে বলে উঠি, 'কবিতা বুঝিনি আমি', যেহেতু তখন আমি জেনে গেছি, বুঝি নাই বুঝি, কবিতাকে তো আমি পেয়ে গেছি। ঠিক তোমার মতন........ ... ...
আসলে, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেণ্টারির মতো, মুক্তিযুদ্ধকে গ্লোরিফাই করার জন্য কোনো গল্প লেখেন নি জহির। এমন কি পুরো গল্প আগাগোড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ের টাইমফ্রেমে বন্দী জহিরের এমন গল্পের সংখ্যা মাত্র একটি। সেটি হলো: “মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা”। এই গল্পে বান্দর হয়ে ওঠে রাজাকার-আল-বদর অথবা সে সময়ের লুটপাটকারী সুবিধাবাদীর প্রতীক। এ বাদে জহিরের অন্যান্য গল্পে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে তীব্র ঝলকানির মতো। আবার কখনো কখনো তা থেকে গেছে ক্রোমা-ক্যানভাসের মতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঘটনাই জহিরের কলমে ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। আর সেটার পেছনে তার ভাষা ও গল্প নির্মাণ টেকনিক বড় সাহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে “কাঁটা” গল্পের কিছু খণ্ডিত অংশ কোড করা যেতে পারে— ... ...
এভাবে চলতে চলতে একদিন চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য প্রকাশ পায়। ফুটোস্কোপ যেহেতু পূর্বজন্মের উদ্ভাবিত আগলপাগল তত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং তদানিন্তন প্রযুক্তি যথেষ্ট কুশলী নয়, ওটিতে ব্যবহৃত একটি লেন্স যথেষ্ট মজবুত ভাবে লাগেনি, ফলে ওটি খসে যায়। পরজন্মের যন্ত্র ব্যাপারি পরজন্মোচিত তত্পরতায় লেন্সের স্থলে একটি ভাঙ্গা আয়নার টুকরো বসিয়ে দেয়ে। পরজন্মের অবজার্ভার পরজন্মোচিত আচরনবিধি অনুসারে আনুপুঙ্খিক নিরীক্ষণ ছাড়াই যন্ত্রটি বীক্ষণের কাজে ব্যবহার করেন। ফলত মননগ্রামটি পরজন্মের প্রতিবিম্ব হয়ে পড়ে। এই অবসরে কটি জীববৈজ্ঞানিক সংকেত পরিচিত হওয়া যাক। ক) হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স : হসস, খ) হোমো স্যাপিয়েন্স সুপিরীয়রো : হসসু, গ)পূর্ব জন্ম : পূজ, ঘ)পরজন্ম : পজ। যাই হোক হোসসু-এর আবির্ভাব বিষয়ে সুমেরিকার জ্ঞানী সমাজে কোনোও দ্বন্দ্ব নেই, শুধু নথি হিসেবে মননগ্রামের একটি অনুলিপি রাখা দরকার। ডেড লাইনও নির্দ্দিষ্টকৃত। ফুটোস্কোপ মেরামতির পরিকল্পনাও শেষ। সে বিশদ অন্যত্র। ইতিমধ্যে পূজ-র সাপুরে খবরওলা যে খেলা দেখাতে এসে পজ-কে খবর সরবরাহ করত, পজর আদালত তাকে জেলে পাঠিয়েছেন। নির্বিষ রাখা পজ-এ জামিন অযোগ্য অপরাধ। কার্য্যত ঝাঁপি বন্ধ আজ। ... ...
যারা বোরো রাজনীতির হাল হকিকৎ সম্বন্ধ ওয়াকিবহাল আছেন তারা সবাই জানেন কী ভয়ানক রক্তক্ষয়ী ও হিংস্র ছিলো এই রাজনীতি। বহু মধ্যপন্থী বোরো নেতাকে সরাসরি মেরে ফেলা হয়। বোরোলিবারেশন টাইগার(বিটিএল), (যেটির নেতৃত্বে ছিলেন এই মোহিলারিই, পরে অব্শ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেন)। বা আগেকার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোরোল্যান্ড(এন ডি এফ বি) - এই দুই দলের ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে বহুজন হতাহত হন। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অবাধ জোগান এইসব আন্দোলনকে খুব সহজেই হিংসাত্মক করে তুলেছিল। এই হিংসা ও খুনোখুনির রাজনীতি বহুদিন ধরেই এই অঞ্চলে চলে আসছে, এমন নয় যে শুধু "অনুপ্রবেশকারী"দের সাথেই প্রথম এখানে হিংসার রাজনীতি পা রাখল। ... ...
অভিযোগ রক্ষার্থে ভরত আর জেলের ডাক্তারকে সামনে নিয়ে আসা হল। কিন্তু সে কি অবাক কান্ড!! কিছুক্ষণ আগে যে ভরতের সাথে দেখা করে এলাম সেই ছেলে আর এই ছেলের মধ্যে কত তফাৎ । সে এক ভীতু বাচ্চা ছেলের মতো যা যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল সবেতেই নিচু স্বরে খালি হ্যাঁ হ্যাঁ করে যাচ্ছিল। তাকে থ্রেট দেওয়া হয়েছিল যাতে আমাদের দিকে সে না তাকায়। সকলের সামনে জেলার তার সাথে খুব ভালভাবেই কথা বলছিল। আমরা জেল থেকে বেড়িয়ে আসার সময় জেলারকে বললাম আসামীদের কোনও অভিযোগ লিখিতভাবে জানানোর জন্য আপনারা নিদেনপক্ষে তাদের সেই সুযোগটুকু করে দিন”। তার পরিপ্রেক্ষিতে জেলার রেগে উত্তর দিল “আপনারা যদি উকিল হতেন তাহলে এই ব্যাপারটা বুঝতেন ভালো করে যে কোনও বন্দীর অভিযোগ জানানোর কোনও অধিকার নেই”। ভরত যখন আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল আমরা গুনগুন করে তাকে আশ্বাস দিলাম “ভয় পেও না”। সে নীরবে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। ... ...
এবার শুরু নতুন ধারার শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরীর কাজ। এ যাবৎ ট্রেড ইউনিয়ন বলতে লোকে বুঝত শ্রমিকদের আর্থিক দাবী-দাওয়া আদায়ের সংগঠনকে, যা বেতনবৃদ্ধি-বোনাস-ছুটি-চার্জশিটের জবাব ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন করার সংগঠন। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক-জীবনের এক-তৃতীয়াংশ, আট ঘন্টার সংগঠন, যে আট ঘন্টা শ্রমিক কলে-কারখানায় কাটান। নিয়োগী শ্রমিকদের খন্ড-বিখন্ড মানুষ হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে, যে মানুষ উৎপাদনের কাজ ছাড়াও পরিবারে-সমাজে থাকে—খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সমস্যা, নিজের অবসর বিনোদন, সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য যাকে ভাবতে হয়, যাকে সম্পর্ক রাখতে হয় সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে। নিয়োগীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন ইউনিয়নের কর্মসূচীতে সামিল হল আর্থিক দাবীর লড়াইয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-পরিবেশ-ইতিহাস চেতনা-নারী মুক্তি-সমাজের অন্যান্য শোষিত অংশের মুক্তি, নিপীড়িত জাতিসত্ত্বার মুক্তির মত বিষয়গুলি। ... ...
ভুল ভাঙল চারদিন পর রাত্তিরের টিভি নিউজে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৬৩তে জগদলপুর থেকে গীদম যাওয়ার পথে বাস্তানারে হাইওয়ের ওপর সকাল নটায় ছুটিতে আসামে নিজেদের ঘরে ফিরতে উৎসুক সি আরপি'র ছয়জন জোয়ানকে মাওবাদীরা ব্লাস্ট করে উড়িয়ে দিয়েছে। এর জন্যে ওরা দিন পাঁচেক আগে পিচ রাস্তায় পাঁচ ফুট নীচে ড্রিলিং করে পাইপের মধ্যে অ্যামোনিয়াম সালফাইড ভরে পুঁতে রেখে ছিল।আজ রিমোট ব্যবহার করতেই আতংক আর হাহাকারের পরিবেশ। গত রোববারই আমাদের কাফিলা সকাল ন'টার সময়েই বাস্তানার পেরিয়েছিল। কয় সপ্তাহ পরে জগদলপুরের থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে হাইওয়ের ওপর বনবিভাগের বাংলোতে রাত্তিরে হামলা করে ভাঙচুর করে, আগুন লাগায়। পরদিন দুপুর বারোটায় আটটি মোটরবাইকে চড়ে ষোলজন পুলিশ রাত্রের হামলার তদন্ত করতে আসে। কাজ শেষ করে ফেরার পথে রেস্ট হাইউস থেকে মাত্র তিনশ' মিটার দূরে ওদের ওপর হামলা হয়। তাতে জনা আটেক মারা যায়। এদের মধ্যে থানাদার মহেন্দ্র সোড়ীর নাম গতবছর কেলেংগায় দুজন আপাতনির্দোষ গ্রামীণকে এনকাউন্টারের অছিলায় মারার জন্যে মাওবাদীদের হিটলিস্টে ছিল। ... ...
বাস্তবিকই, নুড়ি পাথরের জন্য কিছুটা হলেও জল পরিশ্রুত। কিন্তু কতটা? বস্তারের বেশীরভাগ গ্রামে লোকে এমনই জল খায়। পাহাড়ি স্রোত ঝোরাগুলোর জল সমতলভূমির জলের চাইতে কম দূষিত হলেও কখনোই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। বস্তারের গ্রামে আজও ডায়েরিয়ার মড়ক লাগে। গতবছর ছত্তিসগড়ে প্রায় একশ'র ও বেশী লোক কলেরা হয়ে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানতে পেরে যাতে মহামারি আখ্যা না দেয়, সেইজন্য কলেরা ছড়ানোর খবর গোপন রাখা হয়েছিল। এমন খবর উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত ছত্তিসগড়ের গর্ব অবশ্যই খর্ব করতে পারতো। ... ...
এই বাহাত্তর সালেই বরফির সাথে শ্রুতি ঘোষ, অধুনা মিসেস সেনগুপ্তের দেখা। দার্জিলিংয়ের রাস্তার। বরফি তখন দামাল দস্যি যুবক, সাইকেলে বিহার করে, গাড়ির কাচে চুল আঁচড়ায়, বাচ্চা ছেলের চকলেট কেড়ে খেয়ে নেয়, বগল বাজিয়ে নাচে, ঘন্টাঘরের ডগায় চড়ে কাঁটা ঘোরায়। কী কিউট না? এমন ছেলের প্রেমে না পড়ে কি থাকা যায়? অ্যাঁ? শ্রুতি দার্জিলিংয়ে আসা ইস্তক বরফি তার পিছনে পড়ে ছিলো। টয় ট্রেনে যেতে যেতে, খাওয়ার প্লেটে কল্পনার গোলাপ রেখে, চিঠি লিখে বরফি তার প্রেম নিবেদন করলো। তারপর দুজনে বন্ধু হয়ে গেলো এবং ঘোড়ায় চেপে ঘুরতে বেরোলো। এরপরে তারা সাইকেলে এবং টয়ট্রেনেও চেপেছিলো। তারপর একদিন শুভলগ্ন দেখে চুমু খেয়ে তারা পাকাপাকি ভাবে প্রেমে পড়ে গেলো। ... ...
এই তো।দুঃশাসনকে চকিত আক্রমণ করেছে ভীম।এর আগে আক্রমণ করে করে ফিরে যাচ্ছিল বলে দুঃশাসন ধরেই নিয়েছে সে এবারো তাই করবে।ক্লান্তি এবং অসতর্কতার ফসল নিল ভীম। হাঁটুর পিছনের দিকে একটা হাত,আরেকটা হাত বুক আর পেটের সীমান্তে দিয়ে দুঃশাসনকে মাটি থেকে তুলে ফেলেছে।নিজের পা গেঁথে নিয়েছে মাটিতে।যুধিষ্ঠির সমেত বাকী পান্ডবরা উল্লাসে চিৎকার করছে।দুর্যোধনের মুখ গম্ভীর।বাকী কৌরবরাও উৎসাহ দিচ্ছে দুঃশাসনকে হাত দিয়ে ভীমের মাথাটাকে সাপটে ধরার জন্য।বারবার হাত বাড়াচ্ছে দুঃশাসন।কিন্তু ভীম মাথা সরিয়ে নিচ্ছে ওই অবস্থাতেই।দুটো পক্ষ এখানেও স্পষ্ট।ক্রমশ নিজের উপরের হাতের জোর বাড়িয়ে দুঃশাসনকে নিজের হাঁটু থেকে মাটিতে আছড়ে ফেললো ভীম।একই সঙ্গে বাঁ-পাটা বাড়িয়ে প্রথমে কোমরে,তারপরে চেপে বসলো তার বুকের উপরে।প্রশংসনীয় দক্ষতা বটে এই মধ্যম পান্ডবের।শক্তি এবং বুদ্ধির মিশেল আছে এর কৌশলে।তবে এই কৌশল উত্তরাখন্ডের কৌশল না।দুঃশাসনরা কুস্তির এই ধারার সঙ্গে এখনো পরিচিত হয়নি।এ হল পূর্ব দেশের ধারা।নিষাদ,শবর,নাগেরা এই ধারায় লড়ে।জঙ্গলে বাঁচার মতন নিয়ম এই ধারায়।শত্রু নিজের থেকে অনেক দুর্বল হলেই একমাত্র সরাসরি আক্রমণ।না হলে তাকে প্রথমে শক্তিক্ষয় করাতে হবে।তারপরে হানতে হবে অতর্কিতে আক্রমণ।জঙ্গলের যুদ্ধের নিয়ম এ সব।কোথায় ভীম শিখলো জানতে হবে! ... ...
গোমিয়া জায়গাটা আমাদের বাংলার বাইরে। তখন বিহারে ছিল, এখন বোধহয় ঝাড়খন্ডে। সেখানকার খবরের ফলো আপ রিপোর্টিং কোলকাতার কাগজে দীর্ঘদীন ধরে বেরোবে আশা করাই অন্যায়। কলকাতার সমাধান না হওয়া কেসগুলোই কি আর হয়। তবে হ্যাঁ, সেই যে আগের বার বললাম, ‘বিবস্ত্র’ টিবস্ত্র কিছু খুঁজে পেলে হয়, বেশ কিছুদিন ধরেই হয়। ‘সংবাদপত্রের সামাজিক ভূমিকা’ বা এই ধরণের কিছু আর্টিক্ল লিখে পুরষ্কার পাওয়া যেতে পারে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিন্তু এখন সংবাদ শুধুই বিক্রয় নির্ভর। আর শুধু সাংবাদিকরাই বা কেন, আমরা সবাই কেমন বিক্রয় নির্ভর হয়ে যাচ্ছি দিন কে দিন। বহুদিন আগে শোনা নচিকেতার গানটা মাথায় কেমন আটকে গেছে – “সবাই পণ্য সেজে, কাকে কিনবে কে যে, সারাদেশ জুড়ে সোনাগাছি। কেন বেঁচে আছি” – ... ...
এটা নিয়ে একটা তুমুল তর্ক চলতো জীবনানন্দের আসল উত্তরাধিকারী কে? দাবিদার আমার প্রিয়তম দুই কবি, বিনয় ও শক্তি। তখন কবিতাকে বা বলা ভালো বিভিন্ন কবিতার ধারার উৎস হিসেবে একজন বড়ো কবিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রবণতা বড্ডো প্রকট ছিলো। 'রবীন্দ্র অনুসারী' বা অন্যরকম মূঢ় তকমাও ছিলো খুব সুলভ। একটু সরব হয়ে মানুষের দুঃখসুখ নিয়ে চর্চা করতেন যেসব কবি তাঁরা ছিলেন 'সংগ্রামী', কেউ ছিলেন মাতাল, আর কেউ বা পদ্যবণিক। বুদ্ধদেব বসুর 'মতো' যাঁরা , তাঁরা 'বৌদ্ধ' আর বিষ্ণু দের কাছাকাছি ছিলেন 'বৈষ্ণব'রা। ... ...
উপন্যাসে জহিরকে অনেক বেশি এককেন্দ্রিক ও সুসংহত মনে হয়। কারণ, এসময় তাকে পারম্পরিক সাজুয্যপূর্ণ কাহিনী নির্মাণ করতে দেখি ( এখানে ভাষা ও জাদুবাস্তবতার প্রায়গিত জৌলুসের প্রসঙ্গটি উহ্য রাখছি)। কিন্তু গল্পে? গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় এই জহিরই আবার অনেক বেশি বিক্ষিপ্ত। আর সেখানেও চলে আসে জহিরের গল্প বলার নিজস্ব টেকনিকের প্রসঙ্গটি। “পারাপার”এর পর আমরা জহিরের যেসব গল্প পাই, তাতে গল্পকেন্দ্র এতো বেশি ওঠানামা করে যে, তাকে তখন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। বলা যায় না—“গল্পটার পটভূমি হলো এইটা..” অথবা বলা যায় না—“তিনি এইটা বলতে চাইছেন”। এক্ষেত্রে জহিরের টাইম লাইন ভেঙে ফেলার প্রবণতা সাধারণ পাঠকদের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেহেতু জহিরের ভাষাটি বেশ সহজ এবং (সিনটাক্স) প্রায় কথ্য ঢঙের কাছাকাছি, সর্বোপরি একটা চাপা হিউমার তাতে বিরাজমান থাকে, সেকারণে গল্পটি না শেষ করেও পাঠক স্বস্তি পায় না। পাশাপাশি গল্পে নানান মাত্রার রূপক ও ইলিউশন ব্যবহার করে জহির গল্পকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় দাঁড় করান। ... ...
এক পূর্ণিমার রাত্রেই তাঁরা গিয়েছিলেন শ্মশানে। আলো না থাকলে শবনিরীক্ষণ করা যাবেনা। সঙ্গে করে প্রদীপ নেওয়াও চলবে না। তাই প্রকৃতির আলোতেই দেখতে গিয়েছিলেন শব। সদ্য আনা মৃতদেহর সঙ্গে থাকা শবযাত্রীদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেও কদমের বুদ্ধি। সাদা কাপড় জড়িয়ে অর্জুন বৃক্ষের ডালে বসেছিল সে। পূর্ণিমার রাত্রে সকল প্রান্ত যখন আলোয় ভেসে যাচ্ছে তখন ওই কাপড় লেগেছিল অপ্রাকৃত। হাওয়ায় ধীরে ধীরে দুলছে। ব্যাস গাছের নীচে কান্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে গোঁঙানির শব্দ করছিলেন। অরণ্যের প্রান্তের শ্মশানে শবযাত্রীরা ওই দেখে মৃতদেহ নামিয়ে দে ছুট! দুজনে তখন ধীরে ধীরে এসে দেখতে শুরু করেছিলেন শবটি। না। ব্যবচ্ছেদ করা হয়নি তাঁদের। সবে ছুরিটি বের করতেই শ্মশানের পাহারাদার এবং ডোম দুজনেই শবযাত্রীদের আহ্বানে এসে পড়েছিল। দূর থেকেই তাদের হাঁক এবং আসার শব্দ শুনেই ছুট দিয়েছিলেন তাঁরা। পিতার কানে খবর গেলে রক্ষা নেই। আসলে শ্রেষ্ঠীর শব ছিল। তাই অর্থের লোভে শ্রেষ্ঠীর আত্মীয়রাই ফিরিয়ে এনেছিল বাহকদের। নিজেরাও ফিরেছিল। এই খবর কোনো ভাবে পাঁচকান হলে শ্রেষ্ঠীর ছেলের বদান্যতা থেকে বঞ্চিত হবে তারা। শবযাত্রীরা যে এদের নিয়ে ফিরে আসবে এতটা তাঁরা ভাবেননি। দৌড়তে গিয়েই কদম পড়েছিল একটি গর্তের মধ্যে। সেই গর্তে পড়ার সময়েই তার থুতনিতে লাগে চোট। ... ...
ডারউইন সাহেব বলেছেন যোগ্যই টিকে থাকবে, সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট। এই যেমন ডোডো পক্ষী, অ্যাত্তোবড় চেহারা, তায় আবার উড়তে পারেনা। মরিশাসে মানুষ নামল, নিজেরা মুগুর দিয়ে মেরে কিছু খেল, তাদের পোষা কুত্তারা বাকিদের সাবড়ে দিল, তারা পালাতে শেখেনি, সব শেষ। সারভাইভ করেনি, ফিট নয়। সেই যে অক পাখি, ব্যাটাবেটিদের সতীপনার চূড়ান্ত। তেনারা বৈধব্য পালন করতেন। বর বা বৌ মরলে আর বিয়ে করব না। এবার জাহাজের নাবিকরা জাস্ট ফাজলামি করেই কয়েকটা কে গুলি করতে লাগল। যাদের বৌ বা বর মরল, তারা চির বৈধব্য পালন করতে লাগল। নো ছ্যানাপোনা, নট কিচ্ছু। তেনারা শেষ হয়ে গেলেন চিরতরে। সেই যে প্যাসেঞ্জার পিজিয়ন, পায়রাদের মধ্যে সবচেয়ে রংবাহারী। এক এক দল যখন উড়ত, ঝাঁকটা এক মাইল চওড়া আর তিন মাইল লম্বা হত। সংখ্যায় তারা ছিল প্রায় পঞ্চাশ কোটি । উড়ন্ত পাখিগুলোকে আমেরিকার মোটা মোটা ইয়াঙ্কিগুলো ছর্রা বন্দুক দিয়ে পুটুস পুটুস মারত। ভাবত, অত বড় ঝাঁকের মধ্যে দশ বারোটা মারলে আর কি হবে। মজা হচ্ছে, সবাই তাই ভাবত আর তাই সবাই দশ বারোটা করে মারত। অত খেতেও পারতনা, মাঠে ময়দানে পড়ে থাকত। সব শেষ হয়ে গেল মাত্র কয়েক বছরে। সেই যে ইলিশ, আগে গঙ্গায় পদ্মায় ঝাঁকে ঝাঁকে – নাঃ এবার বাড়াবাড়ি করে ফেলছি, অন্য কথায় আসি। ... ...
অষ্টবসুর আট আহ্ণিকে মৈথিলি শব। রোদ রাইসর্ষের মাসতুতো দিদির দ্বিতীয় পক্ষ ননদের মেয়ের মামী হ’লেও, সম্পর্কে আমার বউদি লাগে। খেজুর রসে ধোয়া চোখ জারুল ছায়া। ... ...