তো, নেলী আমাদের সাথেই আছে, অনেক দিন ধরে আছে। নেলী, মানে নেলী নামের অঞ্চলটি, আসামের আর পাঁচটা ছোট মফস্বলের মতই। ঘন সবুজ ধানখেত, দিগন্তে মেঘালয়ের কালো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, দুএকটা জায়গায় সেগুনগাছ-ঝোপঝাড়, ব্যস্ত বাজার, দূর্গাপূজার মন্ডপ, আর জামাকাপড় থেকে বড়সড় মুসলমানদের জনসংখ্যা অনুমান করা গেল। ১৯৮৩-র দিনটিতে কী হয়েছিল তার কোনো স্মারকচিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে এরকমই তো হওয়ার কথা ছিল। দিল্লী ১৯৮৪ বা গুজরাট ২০০২-হত্যাকান্ডকে রাষ্ট্র ন্যূনতম বিচারের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে, তার কারণ তাদের প্রেতাত্মারা ফিরে ফিরে আসে। আর নেলী দেশের দূরের কথা, রাজ্যের রাজনীতিতেও এক বিস্মৃত অধ্যায়। গরিব, পাড়াগেঁয়ে মুসলমানরা মরেছে এরকম এক গণহত্যা কে মনে রাখে। দ্বিতীয়ত, যারা মরেছে মরেছিল অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। ফলে তাদের সুবিচারের দাবি আরেকটু নড়বড়ে হয়ে যায় বইকি। দিল্লী বা গুজরাটের মৃতদের ঠিকঠাক ধর্ম ছিল না, কিন্তু তারা যে ভারতীয় নাগরিক, অনুপ্রবেশকারী নয় এই নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। তৃতীয়ত, হত্যাকান্ড ঘটেছে এক প্রান্তিক প্রদেশে, ভারতীয় মূলভূমি থেকে অনেক দূরে। তাই আমাদের জাতীয় যৌথ বিস্মৃতি ঘণ হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে, নেলীর কথা কেউ শোনে না। একটি হত্যাকান্ডের পরোক্ষ বৈধতার জন্য যখন আগের একটিকে খাড়া করা হয়, নেলীর নাম তখনো আসে না। কেননা নেলীর মধ্যে পরবর্তী কোনো হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেওয়ার মূল্যটুকু নেই। দেশের যৌথ স্মৃতির কাছে নেলী ঘটেইনি। ... ...
বোড়ো ও মুসলিমরা ঐতিহাসিক ভাবে অসমিয়া সমাজের প্রান্তিক মানুষ। অথচ সমাজ ও মিডিয়ার একাংশ বাংলাদেশ থেকে 'অবৈধ' অনুপ্রবেশ কে একপার্শ্বিক ভাবে দায়ী করছেন, যেন এই একটি কারণ সমস্ত হিংসার মূলে। আমরা মনে করি, এই ধরনের সংঘর্ষের এরকম সরল ব্যখ্যা হয় না। জাতিবিদ্বেষের ফাঁদ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা এখন আমাদের সবার জন্য জরুরী। কিছু কায়েমী স্বার্থ সন্ধানী দল , এই হিংসা ও বিপর্যয়ের সময়টিকে বেছে নিয়েছেন, তাদের বহু পুরনো লক্ষ্য চরিতার্থ করতে। বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বিতাড়নের দাবীটি সামনে আনাই তাদের উদ্দেশ্য। হিংসাত্মক কার্যকলাপ আর জীবনহানিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের এই চক্রান্তের আমরা কঠোর ভাষায় নিন্দা করি। আমাদের দাবীঃ ১) হিংসা, অগ্নি-সংযোগ ও হত্যা অবিলম্বে বন্ধ হোক। ২) আসাম সরকার, বিটিসি কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকার জীবন ও জীবিকার এই ক্ষতির সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিক ও উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুক। আমরা আবেদন করি ঃ ১) এই ধ্বংসলীলা রুখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক। ২) শান্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় সংগঠনগুলি একটি মিলিত সমাধানের ডাক দিক। ৩) সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ক্রমাবনতি রুখতে , স্থানীয় ও জাতীয় মিডিয়া, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পরিচয় দিক। ... ...
প্রিয়াঙ্কাঃ শেষ প্রশ্ন এবং ব্যক্তিগত – এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের পিছনে কারন নিয়ে আপনারা পুলিশ ক্যাডাররা কি ভাবেন? আলিঃ দেখুন, আমরা সাধারণ পুলিশ। ২০০৭ সালের আসাম পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী আমাদের একমাত্র কাজ হল অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ করা। আইন- শৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে আমরা আগ্রহী নই। ... ...
এক ভীষণ ভয় জ্বরের মত কাঁপুনি দিল ওর শরীরে। বড়পুকুর কেন বাড়ির পেছনের চাপাকলার বাগানে যেতেই ওর বুক কেঁপে ওঠে। ভয় যেন ওকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। দাদা বউদির শাপ শাপান্ত বেড়েই চলল। ছোট ভাই বোনেরা হোক না হোক, কথায় কথায় ওকে গালাগালি করতে লাগল। চিন্তা করে কুল পায়না কী করে দাদা জরিমানা দেবে? কী করে দাদা মানুষকে ভোজ খাওয়াবে ? খুদকুড়ো আছে বলে একবেলা হলেও সকলের পেটে খাওয়া যাচ্ছে, আর কদিন পর ঝুড়িতে থাকা তলানিটুকুও ফুরিয়ে যাবে! ও ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।তবে এ টুকু বুঝতে পারছে কিছু একটা পথ খুঁজে বার করতেই হবে। শহর থেকে যে দয়ালু লোকগুলো এসেছিল ওদের খুঁজে বার করতে হবে। ওর ফটো তুলছিল যে নম্রশান্তযুবকগুলো, ওদের সহমর্মিতার কথা ওর মনে পড়ল। ধুতিপরা বয়স্ক লোকেদের মা-জননী ডাক ওর কানে ভেসে এল। যে ভদ্রমহিলারা এসেছিলেন তারাই বা কোথায় ? ... ...
শুধুমাত্র পরিবারের কথা বলে যাচ্ছি কারণ এদেরকে কাছ থেকে দেখেছি। এরকম কত পরিবার আছে, কত মানুষ আছে যারা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে আম আদমির কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। এদেরকে আমরা বিদ্বজ্জন বলে মানি না, সম্মান করিনা। কারণ এরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের কাছে আসেন, আমাদের কথা বলেন, গানে, নাটকে, কবিতায়। নিজের চক্ষে সেদিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, গম্ভীরা, মহাভারতের যুদ্ধ, সূর্যশিকার, ক্রীতদাস, গণনাট্যের এক একেকটা প্রযোজনা যখন আছড়ে পড়ছিল, শাসকের বুকে শেলএর মত বিঁধছিল, সেদিন আমি সাক্ষী ছিলাম। সাক্ষী ছিলাম ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঘাড় সোজা করে লড়ে যাওয়া মানুষগুলোর লড়াইয়ের। তাই আজও হুজুগে শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের থেকে ওদেরকেই বেশি আপন মনে হয়। আমার কমরেড। ... ...
অবশেষে একদিন মৃত্যু আসে। আর মধ্যবিত্ত তার হারানো মন আর সময়ের স্মৃতিপুঞ্জসমেত হুমায়ূনকে কবর দিতে যায়। ফিরে আসার সময় তাদের খেয়াল হয়, তাদের প্রথম যৌবন থেকে প্রতিটি যৌবনাগত নতুন যুবক-যুবতী হুমায়ূনি জ্যোছনার কুহক-ধরায় ধরা ছিল। সেই সময় সেইসব মানুষ আর সেইসব কল্পনা অবসিত হলে পরে, হুমায়ূনের সাহিত্যিক জীবনীর আজ প্রথম দিন। ইহকাল শেষে হুমায়ূন সাহিত্যের মহাকালে বাস করা শুরু করলেন। সেই কাল ইতিমধ্যে তাঁর সাহিত্যে দাঁত বসানো শুরু করে দিয়েছে। দেখা যাক... ... ...
হায় রে সন্দেহ! এমন এক রোগ যে বোধহয় কোনো দেহকেই ছাড়ে না। গতি কমালেন বিদুর। গাঙ্গেয়র কক্ষে এখনও লোক। পিতা ব্যাসদেব কাল কুতুহলশালা ছেড়ে আসবেন তাঁর গৃহে, রাত্রিকালে। আজ রাতটি কাটাবেন মাতা সত্যবতীর কক্ষে বলেই অনুমান। যাত্রাপ্রস্তুতির রাত এখন। পান্ডুর সৎকারাদি ক্রিয়া সমাপন হলেই তিনি রওনা দেবেন। আজ রাত্রেই তাঁর গৃহের পার্শ্বস্থ্য নতুন নির্মিত গৃহে গমন করবেন কুন্তী। তাঁর স্ত্রী রাজা দেবকের কন্যা আরেক পারসবী। সে দায়িত্বে আছে এই গৃহসজ্জার। তাঁর পুত্ররাও যথোচিত সাহায্য করেছে তাদের মা-কে। দেবক-কন্যাকে তাঁর হস্তে গাঙ্গেয় সমর্পণ করেছিলেন একদিন। মহারাজ পান্ডু এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহকালেই তাঁর বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই রমণী তাঁর অনুরক্তা এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনুরাগ পরস্পরগামী না হলে তাকে প্রেম বলা যায় না। প্রেম তাঁর একনিষ্ঠ। কিন্তু সেই প্রেমের দায় সারাজীবন বহন করাও কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। বিশেষতঃ, চারপাশে যত সন্দেহের বীজ রয়েছে তাতে কাজটা ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ... ...
‘তানহান্না-নানা-নানা-নাআআআ –‘ কি খুড়ো, সুরটা চেনা চেনা লাগছে? অসাধারণ মিউজিক না? বলতো, সেই কতকাল আগে সাদাকালো টেলিভিশনে যখন ‘সোয়ামী’(স্বামী) বলে সিরিয়ালটা হত, একটা অসাধারণ ফীলিং হ’ত না? দারুণ ছিল গল্পগুলো। হবেনা? আর,কে,নারায়ণের লেখা, সঙ্গে তাঁর ভাই আর,কে,লক্সমণের কার্টুন। গল্পগুলো ‘মালগুডি ডে-স’ নাম দিয়েও চলত কিছুদিন। ওই মিউজিকটা কানে গেলেই কিরকম রোমাঞ্চ হত। তা আমরা নারায়ণ-লক্সমণের কথা তো ঘটা করে পড়তাম, যদিও পরে জেনেছিলাম, এর মধ্যে বেশ কয়েকটা, যেমন স্টীম রোলার লটারিতে পাওয়ার গল্পটা, বিদেশ থেকে টোকা, তাতে কি, টোকা মোকা যাই হোক কী অসাধারণ প্রেজেন্টেশন, বল খুড়ো – এর পরিচালকের নাম জানতে, তুমি? ... ...
কৌশিকঃ আমাদের সবার মধ্যে একটা গান্ডু লুকিয়ে আছে। সুরজিৎঃ তবে কি ওদের ভেতরের গান্ডুকে আমরা চিনতে পারছি না? তাই আমরা ওদের বোঝাতে পারছি না? কৌশিকঃ অথবা ওরা আমাদের ভেতরের গান্ডু কে চিনতে পারছে না, তাই বুঝতে পারছে না। সুরজিৎঃ তাহলে আমাদের আর ওদের গান্ডুর মধ্যে একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেই হয়। কৌশিকঃ তার আগে আমাদের গান্ডুর ব্যাপারটা লিখতে হবে। সুরজিৎঃ বেশ। আমরা যেভাবে গান্ডুকে চিনি, সেটা লিখে ফেলা যাক। কৌশিকঃ গান্ডুর নাম জানি না, ওকে সবাই গান্ডু বলে ডাকে। সুরজিৎঃ ও তো নিজের আসল নাম বলে না, বলে আমি গান্ডু। এই ভাবে শুরু হল গান্ডুর গল্প লেখা। ... ...
আফস্পা ১৯৫৮ বা সোলজার্স ইনসাইড এর মত ছবি ফেস্টিভ্যাল চত্বরের বাইরে বেরোতে পারে না। দেশে বা দেশের বাইরে হাতে গোনা কয়েকটা ফেস্টিভ্যাল ঘুরেই এগুলোর দৌড় শেষ। বলতে গেলে এও এক ধরনের টোকেনিজম। ফেস্টিভ্যাল আহ্বায়করা এগুলো ফেস্টিভ্যালে রাখেন যাতে করে একটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র আবহ তৈরী করা যায়। যেন মনে হয়, গণতন্ত্রে ‘সঠিক পথে’ ওঠা আওয়াজ কেবল যে শোনা হয়, তাই নয়, তাকে তার উপযুক্ত মর্যাদাও দেওয়া হয়। তাই যে রাষ্ট্রপতি গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড দেন, তাঁকেই দেখা যায় উত্তর পূর্বে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা সেলুলয়েডে তুলে ধরা এক সংবেদনশীল পরিচালককে পুরস্কৃত করতে। আপাতভাবে গণতন্ত্রের উপস্থিতি প্রকাশ পায়। আফস্পা নামক একটা ড্রাকোনিয়ন আইন চাপিয়ে দিয়ে তারপর নাগরিকদের যন্ত্রনার কথা সহানুভূতির সাথে শোনার জন্য কিছু মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হয়, স্বীকৃতি দেওয়া হয়, অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। যাতে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে যন্ত্রনাকে আর ততটা যন্ত্রনা বলে মনে না হয়। ঠিক প্রেসার কুকারের মতো। ভিতরের প্রেসার খুব বেশি বেড়ে গেলে কুকার ফেটে যেতে পারে। তাই নজর রাখা হয় যেন কোন ভাবে ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি না হয়। এদিকে আফস্পা-র নাম করে গণহত্যা চলছে, ওদিকে বিশেষ মঞ্চে অ্যাওয়ার্ডও দেওয়া হচ্ছে। ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয় না কারণ, প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে দেওয়াই হয় না। পুরস্কার-স্বীকৃতি প্রদানের এই টোকেনিজম ব্যান করার থেকে বেশি কাজ করে। নাগরিক সমাজের পক্ষে এই দেখনদারি টোকেনিজম এর মোকাবিলা করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ... ...
সাম্প্রতিক কালের এই আবিষ্কারের সাথে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেনবাবুর সম্পর্ক অনেকটাই রেসিং কারের সাথে চাকার আবিষ্কারের সম্পর্কের মতো। চাকা ছাড়া গাড়ি চলে না ঠিকই আবার এটাও ঠিক ইঞ্জিন ছাড়াও চলে না গাড়ি। কিন্তু, মনে রাখতে হবে গাড়ির আবিষ্কার যেখানে আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় সেখানে চাকা কিম্বা ইঞ্জিনের আবিষ্কারের কথা অপ্রাসঙ্গিক তো বটেই, কিছুটা হলেও অবাঞ্ছিত যদিও আগের এই আবিষ্কারগুলো ভবিষ্যতের আবিষ্কারের পথকে সুগম করেছে। এতেও যদি পুরোটা বোঝা না যায় তাহলে বিজ্ঞান বইয়ের পাতা থেকে আর একটি উদাহরণ রাখি সকলের জন্য... ... ...
ঘটনাটা ঘটেছিল দুহাজার ছয় সালের পয়লা ফেব্রুয়ারী। আমার সেই ভাঙাবাড়ি এখন প্রায় গোটা। সে বাড়িকে অনেক রকম নির্মান এবং স্থাপত্যকলার সাহায্যে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। মা আগেই এসেছিল, ক’দিন হ’ল বৌ ছেলেও চলে এসেছে। মেয়ে এখন বিলেতে, তবে ফিরলে এবাড়িতেই উঠবে। টানা হ্যাঁচড়া ক’রে কিছু একতলার মাল ওপরে তোলা হ’ল, কিছু ওবাড়ি থেকেও এসেছে কিন্তু ওপরে এত জায়গা নেই যে সব ধরে যাবে তাতে। তাই একতলাতে কিছু জিনিষ থেকে গেল। পয়লা ফেব্রুয়ারী একটু রাত করেই ছেলে ফিরল ক্যারম ট্যারম খেলে। আমি বললাম, যে শেষে ঢুকবে, তালা লাগানো তার কাজ। যা নীচে সবগুলো তালা লাগিয়ে আয়। মিনিট দশেক পর সে উঠে এসে বলল, বাবা, অনেক চেষ্টা করলাম, তালা কিছুতেই লাগছেনা। আমি বললাম,সেকী! ঠিকই তো ছিল, নেমে দেখলাম নাঃ ঠিকই তো আছে। তবে ও কেন লাগাতে পারলনা ? আসলে ওটা ইঙ্গিত ছিল, বুঝতে পারিনি। ... ...
দীর্ঘ্য শরীরটি চলে গেল দ্বার অতিক্রম করে। হস্তিনাপুর সাম-দান-দন্ড-ভেদের অতিকুশলী এক শাসককে এই ভাবেই যেতে দিয়েছে। কি কৌতুক জীবনের! এই প্রথমবার ব্যাসের নিজেকে কিছুটা খর্ব লাগছে ওই দীর্ঘ্য দেহের তুলনায়। তিনি যাই করুন, যতই করুন, হস্তিনাপুরের শাসকরা তাঁর রক্তপ্রবাহ বলেই পরিচিত। তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় থাকবেই। কিন্তু দেবব্রত একমাত্র হস্তিনাপুরের কাছেই দায়বদ্ধ। দীর্ঘ্যনিঃশ্বাস ফেললেন ব্যাস। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন অনেক কীর্তির অধীশ্বর হবেন হয়তো, কিন্তু তিনি দেবব্রত ভীষ্ম হবেন না। এই সত্য! এই অমোঘ সত্য। ... ...
কিন্তু ভেবে দেখুন আমাদের যে কারুর সাথেই তো এমন হতে পারতো। ঘটনাক্রমে যদি আমি বা আপনি আহমদী বা অন্য কোনো ধর্মের পরিবারে জন্মাতাম তাহলে এই আমাদেরই অত্যাচার, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তায়াহীনতায় দিন কাটতো। একজন মুসলমান নিজের ধর্মে ঠিক যতখানি বিশ্বাস, যতখানি আস্থা রেখে চলেন একজন অমুসলমানের কাছেও তাঁর ধর্ম তো ঠিক ততখানিই। তাহলে সেই বিশ্বাস, সেই আস্থার জন্য তাঁকে বারবার এমন হেনস্থা হতে হবে কেন? আমি জানি রাতারাতি সমস্ত আহমদী বিরোধী নিয়ম কানুন দেশ থেকে উবে যেতে পারেনা। আর নিয়ম কানুন গেলেও মানুষের মন থেকে খুব সহজে এই বৈষম্য মুছে যাবে সে আশাও আমার নেই। কিন্তু অন্তত একটা কাজ আমাদের করতেই হবে।যাঁদের মধ্যে সামান্যতম নৈতিকতা, মানবিকতা আছে তাঁদের আজ এগিয়ে এসে এই ধর্মীয় বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে হবে।লাহোরে যা ঘটেছে, সারাদেশেই যা ঘটছে তার প্রতিবাদ করতে হবে। নেই।আজ এই যে আহমদীদের পক্ষ নিয়ে এতগুলো কথা বললাম এর জন্য পাকিস্তানে আমায় কত সমালোচিত হতে হবে তা আমার অজানা নেই।তবু এই কথা আমি বারবার বলে যাবো। কারণ ,এর মত সত্যি কথা আর কিছু নেই। ... ...
যখন তুমি পুরুষমানুষ থেকে দূরে আছ, খাও যত ইচ্ছে পপকর্ণ, নিজের ভয়ংকর গোপন কথাগুলো নিজেকেই আরেকবার শোনাও ফিসফিস করে। একখানা জ্যান্ত কবিতার বই সঙ্গে রেখ, তোমার দিকে এগিয়ে আসা বিচ্ছুগুলো পিটিয়ে মারার জন্য ওটা লাগবে। খবরদার, ভুলেও বেড়াল কোলে নিও না, যা দিনকাল পড়েছে, স্তনে আঁচড় দেবার ঘটনা গত পরশুও ঘটেছে ভূতের গলিতে। এ সময় ইউক্লিডের উপপাদ্যগুলো মনে আছে কিনা, সেটা আঙুল দিয়ে লিখে দেখতে পার বালিতে। ... ...
উলের বলের মত ক্ষয়মান প্রতিটি বিকেল অতএব হে পাঠক অকালপ্রবীণ কাঁটা ও চুলের মাঝে এইবেলা মাছ খুঁজে নিন সায়াহ্নে আপন পুচ্ছ ধাওয়া করা বিড়ালের শোভনীয় নয় | ... ...
১৭-ই মে রাজ্যের নন-বোড়োগ্রুপের একটা জোটের পক্ষ থেকে বন্ধ ডাকা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দিনটা রজনী ফুকানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রজনী “সুমা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড”-এ চাকুরি করতেন। এই সুমা এন্টারপ্রাইজ এবং আরও তিনটি কোম্পানি- এল.এন্ড.টি., অ্যালস্টম আর টেক্সম্যাকো কে এন.এইচ.পি.সি দুই হাজার মেগা ওয়াটের নিম্ন সুবনসিড়ি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মানের বরাত দিয়েছে। ঠিক আগেরদিন ফুকান ও তাঁর ৪৬২ জন সহকর্মী একসাথে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবতঃ সেদিনই তাঁদের প্রাপ্য টাকা পয়সা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ মিটে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ এর পরে গেলে আর প্রোজেক্ট সাইটে সম্ভাব্য প্রবেশের উপায় থাকত না। ফুকান শুরু থেকেই বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক আবার অক্লেশে একথাও স্বীকার করেন চাকরীটা তাঁর প্রয়োজন ছিল। হয়তো বাঁধটারও। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। ... ...
শাসককুল? আচ্ছা, এ নিয়ে তাঁর কেন মাথাব্যথা হবে? তিনি কে? তিনি তো সামান্য রাজভৃত্য মাত্র! মাতা সত্যবতী যখন যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন কি তাঁকে বলেছেন যাওয়া উচিত হবে কিনা? তাঁকে ডেকে শুধু যাবার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে মাত্র। ব্যাস! তাহলে? তিনি এবং প্রাসাদের কঞ্চুকী প্রধানের মধ্যে পার্থক্য কি? ক্লান্ত, শ্রান্ত একজন মানুষ তিনি। লোকে বলে এই প্রাসাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম আনুগত্য। না। এটা লোকের ভুল ধারণা। তাঁর আনুগত্য তাঁর শপথের কাছে। এই বংশকে তিনি অনেককাল আগেই ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর বোধ তাঁকে বাধা দিয়েছে। একের পর এক বিপর্যয় সঙ্গী হয়েছে কুরুবংশের। কোনো সময়েই শাসনকে স্থায়ী এবং বিপর্যয়মুক্ত দেখেননি তিনি। চলে যেতেই পারতেন! কিন্তু মন বলেছে এভাবে চলে গেলে লোকে বলবে দেবব্রত রাজ্য শাসন করার সুযোগ পায়নি বলে চলে গেল। পিতার জন্য স্বার্থত্যাগ করা থেকে যে ফাঁদ শুরু হয়েছে সেই ফাঁদেই তিনি বন্দী হয়ে পড়েছেন। কোনোদিন ভাবতেই পারেননি কি এই লোকসমাজ? কী ভূমিকা আছে এর? তাঁর জীবন কেমন করে চলবে তা এ নির্ধারণ করার সাহস পায় কোথা থেকে? এসব কিছুই তিনি কখনো ভেবে উঠতেই পারেননি। অথচ তিনি যেমন শান্তনুর সন্তান তেমনই তিনি তো গঙ্গারও সন্তান। তাহলে মায়ের চরিত্রের স্বাধীনতা বোধ কেন তাঁর এল না? এ প্রশ্ন আজ এতবছর পরে এসেছে তাঁর মনে! আবারও যখন ব্যাস তাঁর সাহয্য চাইছেন কুরুবংশকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তখন তিনি ভাবতে বসেছেন। ... ...
বেশ ক’বছর আগের কথা। তা বছর পনের তো হবেই। পুরী বেড়াতে গেছি। সঙ্গে স্ত্রী আর ছেলে। মেয়ে পরীক্ষা ছিল বলে যায়নি। ওখানে গিয়েই মনে হল, ওড়িষার যে সব ভাল ভাল জায়গাগুলো আমি আগে দেখেছি, সেগুলো এদের ঘুরিয়ে দেখাই। ছেলের মা অবশ্য আগেও অনেকবার পুরীতে এসেছে, তবে পুরীর বাইরে খুবজোর কনারক অবধি গেছে। ছেলেতো এই প্রথম এল। নাকের বদলে নরুণের মত মেয়ের বদলে আর একটা মেয়ে পেয়ে গেলাম। আমাদের পাশের ঘরে তাদের পরিবার উঠেছে, আলাপও হল। বললাম, আমি তো একটা গাড়ি নেবই, তুই যাবি আমাদের সঙ্গে? সেও রাজি। চারজনে বেরিয়ে পড়লাম। ... ...
কারা থাকেন এখানে? প্রশ্নটা হল, কারা থাকেন, বা থাকতেন, এই জনামানবশূন্য পোড়ো এলাকায়, যেখানে, নেহাৎই ঘটনাচক্র ছাড়া "সভ্য" মানুষের পা পড়েনা? প্রত্যক্ষজ্ঞানে আমার জানা নেই। তবে জাহাজের ভুলে যাওয়া খোলে যে বাসা বেঁধে থাকে তাড়া খাওয়া ইঁদুরেরা, সিঁড়ির নিচের ভুলে যাওয়া কোন যে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া পতঙ্গদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে সে আর অজানা কথা কি। এদিক-সেদিক থেকে যা জানা যায়, নোনাডাঙাও কিছু ব্যতিক্রম নয়। কলকাতার এই তলানিতে মোটামুটি তলিয়ে যাওয়া লোকজনেরই বাস। এখানে যারা আছেন, তারা কেউ এসেছেন, শহরের অন্যান্য বস্তি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে। কালিকাপুর, খালপাড় থেকে। কেউ এসেছেন সুন্দরবন থেকে, আয়লার পরে। এমনকি সিঙ্গুরের উচ্ছিন্ন কয়েকজন মানুষও নাকি আছেন। এখানকার মানুষদের ইতিহাস মূলত ক্রমাগত উচ্ছেদের ইতিহাস। ... ...