এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • তাঁর সিলেট ভ্রমণ! 

    কিংবদন্তি লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৪ জুলাই ২০২৪ | ২৯৫ বার পঠিত
  • ১৯১৯ সালের দিকে শিলং থেকে সিলেট আসা সহজ কথা না। শিলং থেকে গুয়াহাটি যেতে হত গাড়ি বা কোন এইটা ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে আসাম- বেঙ্গল রেলে চড়ে লামডিং বদরপুর অর্থাৎ হিল সেকশন পেরিয়ে তারপরে সিলেট। ভিন্ন আরেকটা রাস্তা ছিল, তা হচ্ছে শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি, থারিয়াঘাট ছাতক হয়ে, পাহাড়ি পথ খাসিয়া মজুরদের পিঠে বাঁশের থাবা বা থাপ্পাতে বসে। তিনি মানুষের ঘাড়ে করে অতটা পথ যেতে রাজি হলেন না, সিদ্ধান্ত হল তিনি রেল পথেই যাবেন।

    ৩ নভেম্বর তিনি গুয়াহাটি থেকে পুত্র ও পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ৪ নভেম্বর তিনি পৌঁছালেন বদরপুর জংশনে। এখানে আরও সঙ্গী সাথী জুটল, বহর বড় হল। জংশনেই তাঁর সম্মানে লোক সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরো যাত্রা পথেই, প্রতিটা স্টেশনে অগণিত মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছেন, নানান আয়োজনে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁকে! বদরপুর থেকে সুরমা মেইলে করিমগঞ্জ শহরে। এখানে ট্রেন দাঁড়াত মাত্র তিন মিনিট, তিন মিনিটে মানুষের তৃপ্তি মিটে না, ট্রেন দাঁড়াল পঁচিশ মিনিট। প্লাটফর্মেই তাঁকে দেওয়া হল সংবর্ধনা, পড়া হল মানপত্র!

    করিমগঞ্জ থেকে কুলাউড়া জংশনে যখন ট্রেন পৌঁছল তখন বাজে রাত দশটা। তাঁকে আবার ট্রেন বদল করতে হবে। উঠতে হবে সিলেটগামি নতুন ট্রেনে। কিন্তু এই পথে রাতে ট্রেন চলে না। ট্রেনের প্রথমশ্রেণীর একটা কামরায় তাঁকে থাকতে দেওয়া হল, এখানেই রাতটুকু কাটাতে হবে।

    এদিকে এক ইংরেজ সাহেব আসছেন, তিনিও পরেরদিন এই ট্রেনে সিলেট যাবেন। কিন্তু প্রথমশ্রেণীতে উঠতে গিয়ে শুনলেন এখানে তিনি আছেন, অন্য কামরাগুলোতেও তাঁরই লোকজন, তখন সাহেব তাঁদের ঘুমের ব্যাঘাত করা ঠিক হবে না ভেবে স্টেশনের বিশ্রামাগারে বসেই রাত কাটিয়ে দেন। তিনি কোন সময় কুলাউড়ায় এসে পৌঁছবেন এইটা হিসাব করে সিলেট থেকে অগ্রগামী এক দল রাতেই এসে হাজির হয়েছিলেন কুলাউড়ায়, সিলেটের স্বনামধন্য সব ব্যক্তিবর্গ। সবাই রাত কাটালেন স্টেশনে। কুলাউড়ায় পরেরদিন লোকে লোকারণ্য! সবাই ফুল মালা নিয়ে হাজির। একনজর দেখতে চায় সবাই। এর মধ্যে সিলেট থেকে আগত ওয়েলস প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের মিসেস ইথেল রবার্টস রেলের কামরায় এসে কথা বলে গেলেন। সিলেটে তাঁদের বাড়িতেই উনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁরা বাড়ি ঘর ছেড়েই ক্ষান্ত হন নাই, কুলাউড়ায় এসে দেখাও করে গেলেন!
    কুলাউড়ায় দেওয়া হল আরেক সংবর্ধনা। উপচে পড়া ভিড়ের মাঝে ট্রেন চলল সিলেট মুখি।

    সিলেট স্টেশনে মানুষ আর মানুষ। নানান স্লোগান, বাজি পোড়ান চলছে। সিলেট শহর যেন ভেঙ্গে পড়েছে স্টেশনে। শহরের সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি স্টেশনে উপস্থিত। ১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর, সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামলেন সিলেটের মাটিতে!

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সিলেট ভ্রমণকে অনেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। এই ভ্রমণেই কবি মনিপুরী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। এরপরেই তিনি শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্য শেখার ব্যবস্থা করেন, এখান থেকেই শিক্ষক নিয়ে যান। মনিপুরী নৃত্য উনার এতো ভালো লেগেছিল যে তিনি এইটা না করে পারেন নাই।

    এখানেই ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটেছিল। তিনি যে পরশপাথর নিয়ে এসেছিলেন তার একটু স্পর্শে আরেক কিংবদন্তী তাঁর আলোর দেখা পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুরারিচাঁদ কলেজে বক্তব্য রাখেন। দারুণ এই বক্তব্যে তিনি ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষাকে বড় করতে বলেন। এক ঘণ্টার সেই বক্তব্যে তিনি বলেন,
    "আজকের দিনে ভারতবর্ষ বিদ্যাসমুদ্রে এই যে মহাভিড় করা খেয়ায় পাড়ি দিচ্চে, সামনের কোন বন্দর সে দেখতে পাচ্ছে বলত? দারোগাগিরি, কেরানীগিরি, ডেপুটীগিরি। এইটুকুমাত্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এতবড় সম্পদের সামনে এসে দাঁড়িয়েচে এর লজ্জাটা এতবড় দেশ থেকে একেবারে চলে গেছে। এরা বড় করে চাইতেও শিখলে না? অন্য দারিদ্র্যের লজ্জা নেই কিছু আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্যের মতো লজ্জার কথা মানুষের পক্ষে আর কিছুই নেই। কেননা, অন্য দারিদ্র্য বাহিরের, এই আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য আত্মার।"
    হাজার হাজার মানুষ তাঁর কথা শুনেছে। এর মধ্যে থেকে একজন ১৪ বছরের কিশোর কবিকে চিঠি লেখেন, জিজ্ঞাস করেন আকাঙ্ক্ষা বড় করতে হলে কী করতে হবে? কবি সিলেট ছাড়ার দশ বারো দিন পরে এই চিঠির উত্তর এলো! পুরো পরিবার খুশিতে আত্মহারা! কবির জবাবের এই চিঠি তাঁরা বাঁধাই করে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখলেন! এই কিশোর হচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলী!

    সৈয়দ সাহেবের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎকারটাও চমকপ্রদ। কবি মুজতবা আলীকে জিজ্ঞাস করলেন, কী পড়তে চাও? আলী সাহেব বললেন তা জানি না, তবে কোন একটা জিনিস ভালো করে শিখতে চাই। কবি বললেন, একটা কেন? নানা জিনিস শিখলে সমস্যা কী? মুজতবা আলী বললেন মনকে নানা দিকে ছড়িয়ে দিলে কোন কিছুই ভালো করে শেখা হয় না! কবি বুঝলেন এইটা এই ছেলের কথা না, জিজ্ঞাস করলেন এইটা কার কথা? থতমত খেয়ে মুজতবা আলী বললেন, কোনান ডায়েল!
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন, ইংরেজের পক্ষে এমন কথা বলা আশ্চর্য নয়!

    মুজতবা আলী সেদিনই ঠিক করেন যে তিনি নানা জিনিস শিখবেন, নিজেকে সঁপে দিবেন। আর আমরা আজকে জানি লোকটা কত কী-ই না শিখে ছিলেন!

    রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণ নিয়ে আরেকটা গল্প চালু আছে তা হচ্ছে সিলেটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে হাসন রাজার দেখা হয়। এইটা সত্য না। রবীন্দ্রনাথের সাথে হাসন রাজার কোনদিনই দেখা হয় নাই। আরও বেশ পরে হাসন রাজার কিছু কবিতা বা গান কবির হাতে পৌছায়। ততদিনে হাসন রাজা পরপারে পারি দিয়েছেন।

    রবীন্দ্রনাথ নিজে এই ভ্রমণ নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বাসিত ছিলেন। এতো এতো মানুষের উনার প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে ছিলেন। লোকেরা হৃদয় দিয়ে আদর করে থাকে এইটা তাঁকে খুব খুশি করেছিল। তাঁর উচ্ছ্বাস বুঝা যায় ফেরার পরে কলম্বো কলেজের অধ্যক্ষ ইতিহাসবিদ কালিদাস নাগের কাছে লেখা এক চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, "দিনে চারটি করে বক্তৃতা দিয়েছি এমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে" মানুষ যে মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনেছে এইটাও কবিকে আপ্লূত করেছে। তিনি লিখেছেন, এরপরে আবার যখন কিছু বলতে ইচ্ছা হবে (বয়স বাড়লে বাচালতা বাড়ে) তখন শিলেট, চাটগাঁ আসাম প্রভৃতি প্রদেশে গিয়ে হাজির হব, এই রকম স্থির করেছি"

    কী দারুণ একটা মানুষ আর কী দারুণ একটা সময়!

    ( তথ্য সুত্র - সিলেটে রবীন্দ্রনাথ / উষারঞ্জন ভট্টাচার্য )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৪ জুলাই ২০২৪ | ২৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 198.23.5.35 | ১৪ জুলাই ২০২৪ ০১:৩৬534645
  • ভাল লাগল। সত্যিই , কী দারুণ একটা মানুষ আর কী দারুণ একটা সময়!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন