উনাদের কাণ্ড দেখলাম। উনারা একটা বারের উল্টো দিকে বন্ধ দোকান আছে এমন একটা জায়গায় বসে পড়লেন। তারপরে অবাক হয়ে, হা করে অনেকটা বলা চলে সামনের চলমান সিনেমা দেখতে থাকলেন! আমি নতুন মানুষ, যা দেখি তাই আশ্চর্য লাগে, অবাক হয়ে দেখি শুধু। একটু পরে বোধ বুদ্ধি ফিরলে মনে হল আরে করতেছি কী আমি এখানে! অর্ধনগ্ন নারী নাচছে এই দৃশ্য কতক্ষণ দেখা যায়? উনারা আমাকে রেহাই দিলেন। বললেন, চল একটু ঘুরে আসি। চললাম। প্রচুর মানুষ, সব বারে একই দৃশ্য। কাস্টমার ধরার জন্য নানা ফন্দি। আমি দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকলাম। উনারা এবার যা করলেন তা হচ্ছে গলির ভিতরে তস্য গলি খুঁজে বের করলেন। চিপা একটা গলি, ওই গলির দুই পাশে পানশালা, ভিড় প্রচুর। যেহেতু জায়গা কম ঠ্যালা ধাক্কা খাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। তার মধ্যে দোকানদারদেরই বুদ্ধি না মানুষ নিজেই এই কাজ করছে জানি না, ওই অল্প জায়গায় বিকট শব্দে গান বাজিয়ে নাচছে! কোন রকমে ঠেলে ঠুলে পার হলাম গলিটা। ওই পাশে উনারা অপেক্ষা করছেন। যা বললেন তা শুনে আমি মনে মনে কইলামও হরি, রক্ষা কর আমারে! ... ...
মজার গল্প শুনেন। তখন নিয়ম করে ইফতার খেতে যাই। ভলেন্টারি মসজিদে গেছি ইফতার খেতে। এইটা একটু দূরের একটা মসজিদ। একটু নিরিবিলি। বাস থেকে নেমে একটু হাঁটলেই মসজিদ। একটু বলতে এক দেড়শ মিটার হবে হয়ত। আমার সাথে আরও দুইজন। এই সময় বাঘের মত একটা কুকুর কই থেকে জানি এসে হাজির। আমি ঠিক কুকুরপ্রেমি টাইপ মানুষ না। দেশি কুকুরকে মাঝে মধ্যে ঘাড় গলা হাতায় দিছি, ওরা আরামে শুয়ে পড়ছে। কুকুর প্রেম বলতে আমার এই পর্যন্তই। আর যা আছে খিঁচে দৌড় দেওয়ার স্মৃতি। আমি আগে পিছনে একটা কিংবা এক পাল এমন গল্প বহু আছে। কিংবা এক পাল আমাকে ঘিরে ধরেছে আমি কানের হেডফোনের সাউন্ড পুরো বাড়িয়ে দিয়ে গুটি গুটি পায়ে ওদেরকে পার হচ্ছি, আমার যুক্তি হচ্ছে ওদের চিৎকার না শুনলে আমি ভয় পাব না আর ভয় না পেলে আমি দৌড় দিব না, আর আমি দৌড় না দিলে ওরাও চিৎকার করেই থেমে যাবে। রাত বাজে সাড়ে তিনটা না চারটা, আমার বুদ্ধি কাজে লাগছিল, আমি কোন বিপদ ছাড়াই পার হতে পেরেছিলাম। ... ...
আমার রোমানিয়া চলে আসায় জ্যোতি একটু ফাপরে পড়েছে। তবে জ্যোতি তো জ্যোতি, ও নিজেই একশ। আমি আসার আগে পেজের জন্য একটা এজেন্সি ঠিক করে দিয়েছে। আপাতত পেজ নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলছে। আমার আর জ্যোতির যাত্রা বিরতি মনে হলেও আসলে আমরা এক সাথেই চলছি। ... ...
ছোটখাটো কিছু পার্থক্য আমার কাছে দারুণ লেগেছে। যেমন আমি দেশে দেখতাম আমার হিন্দু বন্ধুরা মন্দির যতদূরেরই থাকুক, আশপাশ দিয়ে গেলেই হাত কপালে তুলে সালাম করা শেষ। আমার বন্ধু স্বর্ণ, ও আরও একটু আগানো। ও কোন ঝুঁকি নিতে রাজি না। ও মন্দির, মসজিদ যাই সামনে পরুক, কপালে হাত নিয়ে চুমু খেয়ে ফেলবে ঝপ করে। এইটা আমি দেখছি সব সময়ই। এবার দেখলাম ভিন্ন চিত্র। বাসে যাচ্ছি, দূরে একটা চার্চের মাথা দেখা গেল। বাসের মধ্যে অনেক গুলো হাত এক সাথে উঠে ক্রুশ এঁকে ফেলল! এইটা আমি শুধু সিনেমায়ই দেখছি, বাস্তবে দেখে প্রথমে অবাক পরে হাসি পরে বুঝছি। ... ...
অনেকেই ভাল কোম্পানি পেয়েছে। ভাল আছে তারা। কিন্তু আমি যা দেখছি তাই বললাম। এখন আমি একটা ওষুধ কোম্পানিতে আছি। এই কোম্পানির মাথায় আছে ইরাক, সিরিয়ার কিছু মানুষ। যারা এত বছরেও ইউরোপিয়ান হয়ে উঠতে পারে নাই। অথচ তাদের কোম্পানিতে কাজ করা রোমানিয়ানরা আমাদেরকে বুকে টেনে নিয়েছে আপন করে! এদের জন্যই ভাল আছি। উপরের লোকজনের সাথে কথাবার্তা হয় সামান্য। যাদের সাথে কাজ করি, কাজ করাই তারা অসম্ভব ভাল, এইটাই এখন পর্যন্ত ভাল কিছু ঘটেছে আমার রোমানিয়া আগমনের পরে। ... ...
এই ঘটনা শুরু আরও কয়েকদিন আগে থেকে। বাংলাদেশ থেকে নতুন দুইজন এসেছেন আমাদের কোম্পানিতে। তারা যে এজেন্টের মাধ্যমে এসেছেন আমি সেই একই এজেন্টের মাধ্যমে এসেছি। আমাকে বলা হল আমি যেন এই দুইজনকে আমাদের সাথে রাখি, খাওয়া দাওয়া আমাদের সাথে করাই। আমার সঙ্গী রাজি ছিল না। আমার মনে হল আমরা যখন প্রথম আসছিলাম তখন আমরা নানাজনকে বলছিলাম যে তাদের সাথে যেন আমাদের রাখে, এক সাথে খাওয়া দাওয়া রান্নাবান্না করে খাব। কেউ রাজি হয়নি। তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমি সেই কথা চিন্তা করে বললাম, ঠিক আছে, উনারা থাকুক আমাদের সাথেই। ... ...
আমাদের প্রথম চিন্তাই, আরে ওরা বাংলা বলবে? কী আশ্চর্য! 'আমনে আমাত্তে বেশি বুঝেন' আমাকে বুঝাল আরে আমরা হিন্দি পারি, এইটা আমদের একটা কৃতিত্ব না? ওরা একটা ভাষা জানে বা ইংরেজি সহ দুইটা জানে, আমরা ইংরেজি সহ তিনটা জানি, এইটা ভাল না? অবশ্যই ভাল! এর চেয়ে ভাল উত্তর আর কী হতে পারে? ... ...
কিছু মানুষ আছে তাদের কাছে গেলে শুনতে হয়, বুজ্জেন্নি ভাই, মালয়শিয়া থাকতে…! কেউ কথায় কথায় আরবি, মালয় শব্দ যোগ করে! প্রমাণ করার চেষ্টা তিনি বিদেশ করে এসেছেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাস করি, এইটা কী কইলেন ভাই? খুব খুশি হয়ে তখন এর অর্থ, সমার্থক শব্দ, বিপরীতার্থ শব্দ সব ব্যাখ্যা করে। আমি খুব খারাপ ছাত্র, সব ভুলে যাই কিংবা আসলে কী বলে তা শুনিই না। ... ...
প্রতিটা জায়গায় বিভিন্ন তথ্য রোমানিয়ান, ইংরেজি আর হিব্রু ভাষায় দেওয়া আছে। একটা বিষয় আমার কাছে খুব ভাল লাগল যে রোমানিয়ানরা গণহত্যার জন্য কোন দলকে, মতাদর্শকে দায়ী করেনি। স্পট লেখা আছে, সারা ইউরোপ জুড়ে যখন ইহুদি নিধন শুরু হয় তখন রোমানিয়ান সরকারও ইহুদি নিধনে যোগ দেয়। ওরা ইচ্ছা করলে নাৎসিদের উপরে কিংবা কোন দলের কথা লিখতে পারত। আমরা জানি সে সময়ের সরকার নাৎসি সমর্থক ধরণের কিছু ছিল বলেই এমন একটা কাজে উৎসাহী হয়েছিল। কিন্তু তা না লিখে সরাসরি লেখটা আমাকে অবাক করেছে এবং মুগ্ধও করেছে। সত্যকে আড়াল করে লাভ নাই। ওরা এভাবে লিখেছে এবং পরবর্তী প্রজন্ম যেন জানে সে কথাও লিখেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান আজ পর্যন্ত সত্যটা লিখতে পারেনি। পাঠ্যবইয়ে লেখা ভারত ষড়যন্ত্র করে দুই পাকিস্তান আলদা করেছে! আর পশ্চিম পাকিস্তান দুধে ধোয়া তুলসী পাতা! ... ...
ইউরোপ এদেরকে খুব বেশি বেতন দিবে এমনও না। ভাল বেতন পাওয়ার যে উপায় এরা প্রত্যেকেই তার থেকে শত শত মাইল দূর দিয়ে হাঁটছে। কেন কিসের টানে, কিসের নেশায় পঙ্গপালের মত সবাই রোমানিয়া আসছে তা আসলেই রহস্য আমার কাছে। বুঝার চেষ্টা করছি, যা বুঝছি তা এক ভয়ংকর সত্য। সবাই জায়গা চায় এখানে। ইউরোপ কাওকে ফেরায় না, কষ্ট করলে, কেউ যদি রাষ্ট্র ভেদে চার পাঁচ ছয় আট বছর কাটায় তাহলে এখানকার নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে, সত্য মিথ্যা জানি না, তবে সবাই তাই বিশ্বাস করে। ইউরোপ সবাইকে আশ্রয় দেয়! এখানে থাকলে এক সময় নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, এখানকার একটা পাসপোর্ট কোটি টাকার চেয়েও দামি বলে মনে করে অনেকে। তো? সব যুক্তিতর্ক শেষ! এরা সবাই ইউরোপ নিবাসি হয়ে যাবে। ১৭ বছর যে সৌদি থেকে এসেছে সে জানে আরও ১৭ বছর থাকলেও কোনদিন সৌদি সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিবে না। মালয়েশিয়া দিবে না, সিংগাপুর দিবে না, কাতার দিবে না, কুয়েত দিবে না, কেউ দিবে না। দিবে ইউরোপ। আর এই কারণেই হুমড়ি খেয়ে হাজির সবাই। যেহেতু মূল ইউরোপে ঢোকা কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব তাই সহজে ইউরোপের রাস্তা হিসেবে রোমানিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে। ... ...