ফেরার গল্প শোনো। ভোরে উঠে ট্যাক্সি করে চিৎপুর স্টেশনে চলে গেলাম আমরা। এখান থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকার উদেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেনে যাত্রা বেশ আরামদায়ক। সবচেয়ে বড় আরাম হচ্ছে সীমান্তে আমাদের কোন দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। এই স্টেশনে আমাদের সমস্ত ইমিগ্রেশন, কাস্টমসের কাজ শেষ করে ট্রেনে তুলে দিবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, আবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে( ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন! তুমি এখান থেকে রাজশাহীর ট্রেনে উঠতা!) নামার পরে ঢাকার কাস্টমস অফিসাররা বাংলাদেশের অংশের কাজ কাম শেষ করে মুক্তি দিবে আমাদের। সহজ না? ... ...
রনি, কলকাতায় মার খাচ্ছে বাংলা। এটা বলে বুঝানোর মত না। অকারণে মানুষ হিন্দি বলে! কেন বলে নিজেও জানে না। আপদমস্তক বাঙালি, কোন আন্দাজে হিন্দি বলে চলে সবাই? আমরা ঢাকা থাকা কালে হিন্দি শুনলেই মনে করতাম বিহারী কেউ আছে আশেপাশে! প্রথম নেমে যখন হিন্দি শুনলাম একজনের মুখে তখন আমার মনে হল আরে বিহারী না কি! না, বিহারী না। এরা শিক্ষিত, ভদ্র এবং সবাই হিন্দিতে কথা বলতে চায়। রিকশাওয়ালা, উবার চালক, ট্যাক্সই চালকদের দেখে আমার মনে হয়েছে এরা হয় সবাই ভিন্ন প্রদেশ থেকে এসেছে না হয় এদের মানসিক সমস্যা আছে। এই রোগের চিকিৎসা নিয়ে কলকাতা কী ভাবছে আমার জানা নাই। ভাবছে কি না তাও জানা নাই। এদিক থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে এগিয়ে আছে। বাংলা আমাদের এখনও একমাত্র ভাষা। উবার ডাকেন, হেলিকপ্টার ডাকেন, ড্রাইভার আপনাকে আমাদের দেশে বাংলায়ই ডাক দিবে, এইটা নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। ... ...
জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান ফটকেই আমাকে আটকে দেওয়া হল। বললাম, লাইব্রেরীতে কেন যায়? বই দেখব, পড়ব, হাতাব! মছুয়া দারওয়ান বলল, উঁহু, এখানে ওই সব হয় না! ওই সব করতে হলে আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, কবে আমি আসব তা আগে থেকেই ঠিক করে আসতে হবে। আর যদি সদস্য হওন তাহলে বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন! তাহলে এখন? তিনি জানালেন, ‘ভিজিট’ দিয়ে আসতে পারবেন! ভিজিট দিয়েই না হয় আসলাম। নাম, ঠিকানা, ডাবল ডোজ টিকা চাইলেন, আমি টিপ্রল ডোজ টিকার কার্ড দেখিয়ে, নাম ধাম দিয়ে ঢুকলাম। ওই ঢুকা পর্যন্তই। ভিতরেও একই কাণ্ড। একজন মহিলা আমাকে নিয়ে রিডিং রুমে নিয়ে গেলেন। বললেন, ওই যে ওইটা রিডিং রুম। আমি কাছে যেতে চাইলে বললেন, উঁহু, কাছে যাওয়া যাবে না। বোঝ? আমি এদিকে একটু উঁকি দিতে চাই, নানা কোন দিকে তাকানো যাবে না! একটা ছবি তুলি? নেহি! অজ্ঞতা আর কী, চলে আসলাম। ... ...
হাঁটতে হাঁটতে হুট করে চোখে পড়ল ধবধবে সাদা এক দালান। দেখেই বুঝা যায় গথিক স্থাপনার এক অনন্য নজির এই দালান। কাছে গেলাম, দেখি সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল। অপূর্ব সুন্দর গির্জা। আমার মফস্বল চোখ এত সুন্দর স্থাপনা খুব কমই দেখেছে। রনি, মজার কথা হচ্ছে গির্জায় ঢুকতে টাকা নিলো! কেমন বেশরিয়তি কারবার! মানুষ ঠিকমত ধর্মকর্ম করতে পারবে না? গির্জায় যেতে টাকা নিবে? দশ টাকা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। সিনেমায় যেমন চার্চ দেখি আমরা তেমন একটা চার্চ। দা ভেঞ্চি কোডের শুটিং করা যাবে চোখ বন্ধ করে। আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম। অল্প কিছু মানুষ। নীরবে প্রার্থনা করছে। মনে হল একজনকে জিজ্ঞাস করি যে উনিও দশ টাকা দিয়ে প্রার্থনা করতে আসছেন কি না। কিন্তু তা আর করা হয় নাই। আমি দেখি সারি সারি যে চেয়ার গুলো বসানো তার উপরে মুখোমুখি করে বড় বড় চেয়ারের সারি। দুই পাসেই আছে এমন। এবং সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হল এখানে এখনও ব্রিটিশ আমলের চিহ্ন ধরে রেখেছে। সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রধান প্রধান শহরের চার্চ প্রধানদের জন্য সংরক্ষিত জায়গা এগুলা। লাহোর, বোম্বে যেমন আছে তেমনই ক্যালকাটার পাসেই লেখা ডাক্কা! প্রতিটার জন্য আলাদা আলাদা পতাকা আছে। দারুণ লাগল দেখে। ... ...
একটা অটোতে আমি। অটো চালক আমাকে দেখেই আর সবার মত বুঝে গেলেন আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তিনি হেসে জিজ্ঞাস করলেন, বাংলাদেশ থেকে আসছেন? আমি বললাম, জি, দেখেই বুঝে ফেলছেন? তিনি উত্তর দিলেন না, হাসলেন। একটু আগানোর পরে, বাংলাদেশ তো খুব দারুণ করছে এখন। হাসিনা তো দেখায় দিচ্ছে! আর এদিকে দেখুন, সব চোর বাটপার! আমি কেন আল্লাই জানে বললাম, ভাল খারাপ সব দিকেই আছে, আমাদের ওদিকে তো আরও বেশিই আছে। লুটপাট চলে রীতিমত। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন, এরপরে আবার চালাতে লাগলেন। এদিকের থেকে বেশি চোর আর কোথাও আছে? এইটা আপনে বললেই বিশ্বাস করব আমি? আমি বললাম, আরে, কি বলেন, এদিকের খবর আমরা দেখি না? এখানে তো কত পরিষ্কার ব্যবস্থা, জবাবদিহি আছে। কেউ চাইলেই একটা কিছু… তিনি হা হা হা করে হাসা শুরু করে দিলেন। আমি থেমে গেলাম। এবার তিনি আবার শুরু করলেন কোন নেতা কত খাচ্ছে, কোথায় খাচ্ছে, দেশটা যে উজাড় করে নিয়ে নিচ্ছে সব চোরেরা এইটা তিনি নিশ্চিত। কবে মুখ থুবড়ে পড়বে এইটাই এখন দেখার বিষয়। আমিও বলা শুরু করেছিলাম প্রায়। হুট করেই মনে হল অনেক আগে পড়া বেসিক আলীর কমিক স্ট্রিপের একটা পর্বের কথা। ... ...
আমার কলকাতা ঘুরার জন্য আমি একটা ছোটখাটো তালিকা বানিয়েছি। এক নম্বর হচ্ছে ৮ থিয়েটার রোড। মুশকিল হচ্ছে থিয়েটার রোড বলে কোন রোড এখন আর নাই, এখন হচ্ছে শেক্সপিয়ার সরণি। আরও মুশকিল হচ্ছে আমি কেন থিয়েটার রোড যেতে চাই এইটা কেউ জানেও না। ভারতীয় সরকারও না, বাংলাদেশ সরকারও না! কী একটা আশ্চর্য কাণ্ড না? অথচ আমার কাছে কলকাতা এই কারণেই, আট নাম্বার থিয়েটার রোডের জন্যই বিশেষ। আমার কাছে কলকাতা প্রাচীন দালানের জন্য আকর্ষণীয় না, ভিক্টরিরা মেমোরিয়াল না দেখে দেশে ফিরলে বিন্দুমাত্র আফসোস হবে না, যাদুঘরের জন্য না, কম দামে জিনিস পাওয়া যায় এই কারণে না, আমার কাছে কলকাতা বিশেষ কারণ এই পথে এক সময় সুনীল শক্তিরা রাত জেগে শহর পাহারা দিয়েছে। বিশেষ কারণ এইখানে এমন কিছু মনিষীর আগমন ঘটেছিল যারা বাঙালি জাতির দিক পথ পরিবর্তন করে দিয়েছিল। শহর হিসেবে ঢাকার থেকে ঢের নবীন শহর কলকাতা, অথচ বাঙালি জাতির উপরে এর প্রভাব পড়েছে অনেক অনেক বেশি। আর প্রধান কারনই হচ্ছে এই মনিষীরা। আমি একটা টান অনুভব করি কারণ এখানে, এই ১৩৪, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে এক সাধক বাস করতেন, যার জীবন আমাকে অদ্ভুত ভাবে টানে। মনে হয় সব ছেড়ে শিবরাম হয়ে যাই। এই কয়দিনে কতদূর দেখতে পারব জানি না। চেষ্টা করব যতদূর যাওয়া যায় যাওয়ার। ... ...
আমার বাবাকে শেরপুরের মানুষ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করতেন। সাধারণ মানুষ আব্বাকে চিনত এমন না, কিন্তু যারা এই ধারায় আছে তারা সবাই এক নামেই চিনত। শহরের বড় বড় মসজিদের ইমাম, ইসলাম বুঝে জানে এমন লোকজন আব্বাকে মান্য করত। আব্বার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছি অনেকেই। কোন মসজিদ বা মাদ্রাসায় আব্বার নাম বললে উনার নাম শুনা মাত্র নড়েচড়ে বসত সকলেই। আব্বা আমাদের এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তেন না, কারণ এখানে যে নামাজ পড়ায় তিনি অল্প বয়সই, আব্বা তৃপ্তি পেতেন না তার পিছনে নামাজ পড়ে। হেঁটে দূরের এক মসজিদে যেতেন শুধু মাত্র সেই ইমাম সাহেবকে আব্বার মনে হত উনার মাপের, যার সাথে কথা বলা যায়, আলাপ করা যায়। সেই ইমাম সাহেব আমাকে অনেকবার আমার কাছে আব্বার প্রাণ খোলা প্রশংসা করেছেন। এক বাক্যে স্বীকৃতি দিছেন যে আব্বার মত ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানী মানুষ তিনি খুব কমই দেখেছেন। তিনি পরে শেরপুরের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমাম হয়ে ছিলেন, এবং তখনও উনার আব্বার প্রতি মুগ্ধতা কাটেনি। আব্বা যখন অসুস্থ, বিছানায় পড়ে গেছেন। তখনও আমি দেখতাম কোথা থেকে কোথা থেকে মানুষ আসত, উদ্দেশ্য আব্বার সাথে দেখা করা আর একটু আলোচনা, ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে গল্প। আমি আব্বার এই দিকের কথা কেন বলছি? কারণ আমি আব্বাকে কোনদিন নববর্ষের বিরোধিতা করতে দেখি নাই। আব্বা নিশ্চয়ই মঙ্গল শোভা যাত্রায় অংশ নেয় নাই। কিন্তু মেজোপা যখন নববর্ষ উপলক্ষে একটা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া এনে দিত তখন তিনি আগ্রহ নিয়েই পরতেন, খুশিতে চোখ নেচে উঠত উনার। বাব্বাহ! আমার জন্য আনছ, বলে হাতে নিতেন, হাসতেন। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন ফোন দিয়ে বলতাম, আব্বা, শুভ নববর্ষ, তিনিও সাথে সাথেই শুভেচ্ছা জানাতেন নববর্ষের। নববর্ষ উপলক্ষে ভাল মন্দ রান্না হয়েছে কি না তার খোঁজ নিতেন, আগ্রহ নিয়ে খেতেনও। আমি আমার সমস্ত জ্ঞান বাজি রেখে আপনাদের বলতে পারি যে কাঠ মোল্লা জাহান্নাম যাওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন গলা ফাটাইয়া, আমার বাবা তার চেয়ে বেশি জানতেন, ধর্ম, ইসলাম, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র সম্পর্কে। ... ...
যে দেশে কিছু না করেই অল টাইম দৌড়ের উপরে থাকতে হয় হিন্দুদের, যে দেশে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিকল্পিত ভাবে ম্যাসাকার করা হয় এবং যার কোন বিচার হয় না ,যে দেশে নিয়ম করে প্রতিমা ভাঙা হয়, যে দেশে গুজবের উপরে ভর করে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কোন বিচার হয় না, সেই দেশে কেউ হিজাব পরার অপরাধে মারছে! কোন মাপের মগজহীন মানুষ হলে এইটা বিশ্বাস করা সম্ভব? ... ...
নিছক আবেগ না। তখন প্রশ্নটা ছিল পেটে লাথি খাওয়ার। জীবন জীবিকার প্রশ্ন। রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হলে কি হবে তা দেশ ভাগের অল্প দিনেই বুঝে গিয়েছিল বাঙালী। তাই আবেগের প্রশ্ন ছিল না, ছিল জীবনের প্রশ্ন। তৎকালীন বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সবাই বুঝে গিয়েছিল উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে এই জীবনে আর পাকিস্তানের সাথে পেরে উঠা যাবে না। দেশ ভাগের পরেই যখন মানি অর্ডার ফরম, ডাক স্ট্যাম্প, চিঠির খাম সব উর্দু ভাষায় এসে হাজির হল তখনই বুঝা হয়ে গিয়েছিল উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে আসলে কত বড় সর্বনাশ হবে। তাই ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না। ছিল জনগণের আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। তাই শহিদের তালিকায় এক বরকত ছাড়া আর কাওকে ছাত্র খুঁজে পাই না, সবাই কর্মজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ। ... ...